নেত্রকোনার মহাশোল; এক বিলুপ্তপ্রায় মাছ

মহাশোল একটি বিলুপ্তপ্রায় মাছ। মহাশোল মাছটি এখন কালে ভদ্রে দেখা মেলে। মহাশোল মাছটি দেখতে বা চিনতে হলে এখন ইন্টারনেটের সাহায্য নিতে হয়। তরুণ প্রজন্মের কাছে মহাশোল মাছটি যেন নতুন এক নাম। অনেকে তো মনে করেন যে, মহাশোল মাছটি বোধহয় বড় আকৃতির শোল মাছ। 

নদীর পাথর-নুড়ির ফাঁকে ফাঁকে 'পেরিফাইটন' নামের এক রকমের শ্যাওলা জন্মে। এগুলোই মহাশোলের প্রধান খাদ্য। মহাশোল সর্বোচ্চ ১৫ মিটার গভীর জলে চলাচল করতে পারে। মহাশোল মাছ দেখতে অনেকটা মৃগেল মাছের মতো হলেও এর আঁশগুলো আরও বড়। পরিণত মাছের আঁশ শক্ত, উজ্জ্বল সোনালি রঙের ও দীপ্তিমান। পাখনা ও লেজ রক্তিম। নাকের সামনে ছোট্ট দুটি গোঁফের মতো আছে। সব মিলিয়ে দেখতে খুব সুন্দর। আমাদের মিঠাপানির মাছের মধ্যে মহাশোল স্বাদেও সেরা। মাছটি ওজনে সাধারণত ১৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। মাছটি দামের দিক দিয়েও আগলে রেখেছে শীর্ষ অবস্থান। আকার ভেদে প্রতিকেজি মাছ ২ থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হয় যা অন্যান্য কার্প জাতীয় মাছের বাজার তুলনায় ৬ থেকে আটগুণ বেশি।

মহাশোলের জন্ম ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাদদেশে নেত্রকোনা জেলার সীমান্তবর্তী সুসং দুর্গাপুর গারো পাহাড়ের খাদে। বড় আঁশযুক্ত মহাশোল খরস্রোতা নদীর উজানের পরিষ্কার, স্রোতশীল পানিতে থাকে এবং পাথরযুক্ত তলদেশ পছন্দ করে। বিশ্বব্যাপী মৎস্য শিকারীদের কাছে গেম ফিস হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিনোদনসঙ্গী এই মহাশোল। প্রাকৃতিক নিয়মেই পাহাড়ি খাদে জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা ওই মাছের বৈশিষ্ট্য হলেও সেখানে আহরণ সম্ভব নয়। মহাশোল ভরা বর্ষায় প্রবল বর্ষণ ও স্রোতের টানে ১০০-১৫০ ফুট পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে আছড়ে পড়ে। পাহাড়ের খাদ থেকে পড়ে মুক্ত জলরাশিতে মনের আনন্দে দ্রুত গতিতে ছুটতে গিয়ে সোমেম্বরী নদীতে জেলেদের পেতে রাখা জালে ধরা পড়ে মাছটি। কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল যেমন-ময়মনসিংহ, সিলেট, দিনাজপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের খরস্রোতা নদী, ঝরনা, লেক এবং পার্শ্ববর্তী খালে বিলে এর প্রাচুর্য ছিল। বর্তমানে বিভিন্ন মনুষ্যসৃষ্ট এবং প্রাকৃতিক কারণে এদেশে মহাশোলের বিচরণ এবং প্রজননক্ষেত্র প্রতিনিয়ত বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। 

বাংলাদেশে মহাশোলের দুটি প্রজাতি আছে যাদের নাম সোনালী মহাশোল এবং লাল-পাখনা মহাশোল। প্রজাতি দুটি মহাবিপন্ন। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের রক্ষিত বন্যপ্রাণীর তালিকার তফসিল ২ অনুযায়ী এই প্রজাতি দুটি সংরক্ষিত।

নেত্রকোনার দুর্গাপুরে কংস নদী ও সোমেশ্বরী নদী মহাশোলের আবাস। এই নদ-নদীর উৎসমুখ এখন প্রায় বন্ধ। শুকনো মৌসুমে নদী দুটি প্রায় শুকিয়ে যায়। বসবাস ও বংশবৃদ্ধির জায়গা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মহাশোল ধীরে ধীরে কমতে থাকে। একপর্যায়ে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। সোমেশ্বরী ও কংস ছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে দু-একবার সাঙ্গু নদেও মহাশোল পাওয়া গেছে। তবে হাওর, বিল-ঝিল বা অন্য কোনো নদ-নদীতে মহাশোল পাওয়ার রেকর্ড নেই বাংলাদেশের মৎস্য অধিদপ্তরের কাছে।

মহাশোলের প্রায়-বিলুপ্তির কারণে বিএফআরআই নেপাল থেকে এ মাছের পোনা আমদানি করেছিল আশির দশকে। পরে পুকুরে পোনা ছেড়ে প্রজনন কৌশল ও জিনপুল সংরক্ষণ করা হয়। সম্প্রতি বিএফআরআই থেকে এ মাছের পোনা উৎপাদনসহ চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবন করা হয়। উৎপাদিত মহাশোলের পোনা এরই মধ্যে রাঙ্গামাটি কাপ্তাই লেক, সোমেশ্বরী নদী এবং কংস নদে অবমুক্ত করা হয়েছে।বর্তমানে ময়মনসিংহ এবং তার আশেপাশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও ভোলা, ফেনী, খুলনা এবং সিলেট অঞ্চলে এ মাছের চাষ করা হচ্ছে। ফলে সাম্প্রতিককালে মহাশোল মাছের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। 

Share on Google Plus

About Ripon Abu Hasnat

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন