দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়; স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়। নেত্রকোনার সবচেয়ে প্রাচীন বিদ্যাপীঠ। জেলা শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘেঁষে অবস্থিত এই বিদ্যালয়টি এক শ’ ৩১ বছর ধরে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। ১৮৮৯ সালে ময়মনসিংহের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রথম সভাপতি রমেশ চন্দ্র দত্ত (আর.সি দত্ত নামে তিনি সমধিক পরিচিত) নেত্রকোনা মহকুমায় এসে দেখেন এখানে কোনো বিদ্যালয় নেই। তিনি স্থানীয় সুধীজনদের সঙ্গে অলোচনা করে শহরের মধ্যভাগে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয় সুধীজন বিদ্যালয়ের জন্য জমিদান করেন। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় রমেশ চন্দ্র দত্তের অবদান স্বীকার করে স্থানীয় জনগণ তারই নামের টাইটেলে বিদ্যালয়ের নামকরণের প্রস্তাব করেন এবং তা সর্বসম্মতক্রমে গৃহীত হয়। ১৮৮৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনায় প্রথম মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে দত্ত উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন বৃটিশ আমলে এ বিদ্যালয়ই ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরিপ্রাপ্ত একমাত্র বিদ্যালয়। 

অতীতের ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠানটি আজও ধরে রেখেছে তার ঐতিহ্য ও সুনাম। প্রতিষ্ঠার মাত্র ৬ বছরের মাথায় ১৮৯৫ সালে এ বিদ্যালয়ের ছাত্র আনন্দ চন্দ্র মজুমদার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এন্ট্রাস পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় তৃতীয় এবং এর পাঁচ বছর পর ১৯০০ সালে রাজেন্দ্র কুমার দত্ত নবম স্থান অধিকার করেন। তাদের কৃতিত্বের কারণে তখনকার সময়েই প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য কয়েকজন শিক্ষার্থী হলেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার অর্থমন্ত্রী ও কলকাতা কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র নলিনী কান্ত সরকার, শান্তি নিকেতনের সঙ্গীত বিভাগের অধ্যক্ষ শৈলজা রঞ্জন মজুমদার, কলকাতার নামজাদা সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী, প্রাক্তন ক্যাবিনেট সচিব সিদ্দিকুর রহমান, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্যসচিব ড. কামাল সিদ্দিকী, প্রাক্তন সচিব দুলাল হাফিজ, কবি হেলাল হাফিজ, ময়মনসিংহ কমিউনিটি বেইজড্ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ডা. মোফাক্কারুল ইসলাম ভুঁইয়া, সাবেক সচিব ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য উজ্জল বিকাশ দত্ত এবং সাবেক আইজিপি ও রাষ্ট্রদূত হাসান মাহমুদ খন্দকার।

প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই সাফল্যের নানা স্বাক্ষর রেখে আসছে দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়। বিশ শতকের ত্রিশের দশকে নেত্রকোনায় নারী শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়। ওই সময়ে নেত্রকোনা মহকুমা শহরে তিনটি উচ্চ বিদ্যালয় থাকলেও মেয়েদের কোন উচ্চ বিদ্যালয় ছিল না। দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান রেক্টর জ্ঞানেশ রঞ্জন রায় ১৯৩৩ সালে মাত্র আট নারী শিক্ষার্থীকে নিয়ে সপ্তম শ্রেণীর পৃথক শাখা চালু করেন। ১৯৩৭ সালে ওই আটজনই প্রবেশিকা পাস করে। বাংলাদেশে শান্তিনিকেতনের বাইরে প্রথম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন পালন করেও আরেক ইতিহাসের জন্ম দেয় দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন শান্তিনিকেতনের সঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষ শৈলজারঞ্জন মজুমদার। খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলন সংগ্রামেও দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবদান অনস্বীকার্য। এক সময় দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ই ছিল নেত্রকোনায় ছাত্র আন্দোলন এবং সংস্কৃতি চর্চার প্রাণ কেন্দ্র। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

নেত্রকোনা শহরের প্রাণকেন্দ্র এবং অভিজাত পাড়া হিসেবে পরিচিত মোক্তারপাড়ায় বিদ্যালয়টির অবস্থানও মনোরম পরিবেশে। বিদ্যালয়ে যাতায়াতের যেমন রয়েছে একাধিক সড়ক তেমনিই পাশে বিদ্যালয়ের ভূমিতেই রয়েছে নেত্রকোনার ভাষা শহীদের প্রধান শহীদ মিনার। শিক্ষার্থীদের ভর্তির চাপ থাকায় বিদ্যালয়টিতে ২০১৫ সাল থেকে দুই শিফট চালু করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ এখন ডিজিটালাইজড। অবকাঠামোগতভাবে বিদ্যালয়টি এখন অনেক উন্নত। রয়েছে বিশাল দ্বিতল ভবন। বড় ক্যাম্পাস। প্রায় ৫ হাজার বই সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। বিদ্যালয়ে রয়েছে একটি আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব। বিদ্যালয়টির জমির পরিমাণ ৪ দশমিক ৩৩ একর। এতো জায়গা জেলার আর কোনো স্কুলে নেই। বিদ্যালয়ের স্কুল কম্পাউন্ডের বাইরে শহরের ভিতর জয়নগর মৌজায় রয়েছে নিজস্ব খেলার মাঠ। এ বিদ্যালয়ের নিজস্ব আয়ের উৎস রয়েছে। বিদ্যালয় সংলগ্ন ভূমিতে অর্ধশতাধিক দোকানঘর থেকে ভাড়া আদায় হচ্ছে। শুধু প্রাচীন বলেই নয়, সব দিক থেকেই দত্ত উচ্চ বিদ্যালয় একটু আলাদা, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত।
Share on Google Plus

About Ripon Abu Hasnat

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন