দুর্গাপুরের আসল সৌন্দর্যই বলা হয়ে থাকে এই সোমেশ্বরী নদীকে। পাহাড়, নদী আর গাছপালা দিয়ে ঘেরা নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার সোমেশ্বরী নদীর সৌন্দর্য আপনার নজর কাড়বেই। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বিঞ্চুরীছড়া, বাঙাছড়া প্রভৃতি ঝর্ণাধারা ও পশ্চিম দিক থেকে রমফা নদীর স্রোতধারা একত্রিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে সোমেশ্বরী নদী। এ নদী মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা বাজার (পূর্ব নাম বঙ বাজার) হয়ে বাংলাদেশের রাণীখং পাহাড়ের কাছ দিয়ে সোমেশ্বরী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সোমেশ্বরী নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এটি ভারতের মেঘালয়ের পশ্চিম গারো পাহাড় জেলা এবং বাংলাদেশের নেত্রকোণা জেলায় প্রাবাহিত একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ৫০ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১১৪ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার।
নদীটি এক সময় সিমসাং নামে পরিচিত থাকলেও, ৬৮৬ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে সোমেশ্বর পাঠক নামে এক সিদ্ধপুরুষ অত্রাঞ্চল দখল করে নেয়ার পর থেকে নদীটি সোমেশ্বরী নামে পরিচিতি পায়। নদীর তীরে ধীবররা বসবাস করত। তাদের বলা হতো 'পাটুনি'। তখন ওই অঞ্চল শাসন করত গারো সম্প্রদায়ের এক দলপতি, যার নাম বাইশা গারো। বিভিন্ন কারণে বাইশা গারোর ওপর ধীবররা সন্তুষ্ট ছিল না। কিন্তু শক্তি সাহস কম বলে তাকে মেনে নিতে বাধ্য ছিল। ১২৮০ খ্রিস্টাব্দে অসামান্য বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও বলিষ্ঠ সোমেশ্বর পাঠক কামরূপ কামাখ্যা ইত্যাদি তীর্থ দর্শন শেষে গারো পাহাড়ে আসেন। সুমসাং নদী তীরের নীরবতা সোমেশ্বর পাঠককে মুগ্ধ করে। সোমেশ্বর তার অনুচরদের নিয়ে সেখানেই আস্তানা গাড়েন। ক্রমে যোগাযোগ গড়ে ওঠে ওই এলাকার জেলেদের সঙ্গে। ধীবররা তাকে দেবতা এবং ত্রাতা মনে করতে থাকে। তাকে ঘিরেই গড়ে ওঠে দুর্গাপুর গ্রাম। সোমেশ্বর পাঠক সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন সঙ্গে করে নিয়ে আসা লক্ষ্মীনারায়ণের বিগ্রহ। সোমেশ্বর তার স্বজনদের নিয়ে এসে বসতি গড়েন সেখানে। এতে তার শক্তি আরও বৃদ্ধি পায়। এক সময় সুযোগ বুঝে ওই এলাকার অত্যাচারী শাসনকর্তা বাইশা গারোকে পরাজিত করে প্রতিষ্ঠা করেন 'সুসং রাজ্য'। ওই এলাকার ধীবররা সোমেশ্বর পাঠককে সাক্ষাৎদেবতা মনে করত। তারা ভাবত, জেলেদের উন্নতির জন্যই সোমেশ্বর ঠাকুর নিজ হাতে সুসং রাজ্য গড়েছেন। তারা এও মনে করত, সুসংয়ের মানুষের পানিকষ্ট দূর করতেই প্রভু সোমেশ্বর নিজ হাতের 'ভৃঙ্গার' থেকে পানি ঢেলে দেওয়ায় সেখান থেকে সৃষ্টি হয় সোমেশ্বরী নদী। তবে অনেকের ধারণা, উত্তর পাহাড়ের ঝর্ণাধারা 'সমসাং' বয়ে যেত ওই এলাকার মধ্য দিয়ে। সে ঝর্ণাধারার গতিপথ পরিবর্তন করে সোমেশ্বর পাঠক তা নিয়ে এসেছিলেন সুসংয়ের রাজধানী দুর্গাপুরের কাছে। এ কারণেই ওই নদীর নাম হয় সোমেশ্বরী নদী। আবার এমন ধারণাও প্রচলিত রয়েছে যে, সিমসাংগ্রি থেকে উৎপত্তি হয়েছে বলে এর নাম সোমেশ্বরী রাখা হয়েছিল।
রাণীখং পাহাড়ের পাশ বেয়ে দক্ষিণ দিক বরাবর শিবগঞ্জ বাজারের কাছ দিয়ে সোমেশ্বরী নদী বরাবর পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। সেই পথে কুমুদগঞ্জ বাজার হয়ে কোনাপাড়া গ্রামের সামনে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাকলজোড়া, সিধলি, কলমাকান্দা, মধ্যনগর হয়ে ধনু নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে সোমেশ্বরী। সোমেশ্বরীর মূলধারা তার উৎসস্থলে প্রায় বিলুপ্ত। বর্ষা মৌসুম ছাড়া অন্য কোন মৌসুমে পানি প্রবাহ থাকে না। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে পাহাড়ীয়া ঢলে সোমেশ্বরী বরাবর দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে নতুন গতিপথের সৃষ্টি করেছে। যা স্থানীয় ভাবে শিবগঞ্জ ঢালা নামে খ্যাত। বর্তমানে এ ধারাটি সোমেশ্বরীর মূল স্রোতধারা। এ স্রোতধারাটি চৈতালি হাওর হয়ে জারিয়া-ঝাঞ্জাইল বাজারের পশ্চিমদিক দিয়ে কংশ নদী সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ১৯৮৮ সালে পাহাড়ীয়া ঢলে আত্রাখালি নদী নামে সোমেশ্বরী নদীর একটি শাখা নদী সৃষ্টি হয় যা সুসঙ্গ দুর্গাপুর বাজারের উত্তর দিক দিয়ে সোমেশ্বরী নদী থেকে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে। কিছু দূর এগিয়ে সোমেশ্বরীর মূলধারা সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আত্রাখালি নদী এখন বেশ খরস্রোতা। আবার সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৪ সালের ভয়াবহ বন্যার পর আত্রাখালি থেকে নয়া গাঙ নামের আর একটি স্রোত ধারা উত্তর দিকে সৃষ্টি হয়েছে। আরো ভাটিতে সোমেশ্বরীর শাখা নদীর সৃষ্টি হয়েছে গুনাই, বালিয়া ও খারপাই।
এক এক ঋতুতে এ সোমেশ্বরী নদী এক এক ধরণের রূপ লাভ করে। বর্ষায় যেমন এই নদীর পানি বেড়ে গেলেও, শীতে এর পানি হাঁটুজল থাকে। বছরের বেশিরভাগ সময় সোমেশ্বরীর একপাশ জুড়ে থাকে ধু ধু বালুচর, অন্য পাশেই হালকা নীলাভ জল। পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরীর স্বচ্ছ হাঁটুজলে পা ভিজিয়ে হাটার লোভ সংবরণ করা বড়ই কঠিন। এ পানিতে পা ডুবিয়ে হাঁটতে গেলে মোটা বালু পায়ের পাতায় শিরশির অনুভূতির সৃষ্টি করে। শুকনো মৌসুমে সোমেশ্বরী নদী যৌবন হারিয়ে প্রায় মরা নদীতে রূপ নিলেও তার বুক জুড়ে থাকে বিস্তীর্ণ সোনালী-লাল বালু- যা দেখলেই মনে হবে সোনার বাংলার বুকে এক সোনালী বৈচিত্রময় পর্যটন স্পট। গারো পাহাড়ের বুক চিরে প্রবাহিত সোমেশ্বরী নদীর এক পাশে খরস্রোতা বয়ে চলছে- যে দৃশ্য মনোমুগ্ধকর, এসব দৃশ্য অবলোকন করে পর্যটকরা সারাদিন ঘুরে ফিরে সোমেশ্বরী নদী ও তার দু'পাড়ের আদিবাসী মানুষের বৈচিত্রময় জীবনযাপন, শিল্প-সংস্কৃতিসহ অনুপম কালচারাল সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। পাহাড়ের ঢাল থেকে বয়ে আসা ঝরনার পানিই এই নদীর মূল উৎস। ঝরনার পানি হওয়ায় এর পানি অতি স্বচ্ছ ও ঠান্ডা। দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজ ছাড়াও নানাভাবে এই নদীকে ব্যবহার করে স্থানীয়রা। সোমেশ্বরীতে রয়েছে ‘কালো সোনা’। মাটি তুলতে তুলতে সেটার ভেতরে মুক্তার দানার মতো কালো রঙের খনিজ পদার্থ মেলে বলে এর নাম কালো সোনা। এটির খনিজ মূল্য আছে। এছাড়াও এখান থেকে তোলা হয় কয়লা আর বালু। এই সোমেশ্বরীর তীরেই রয়েছে সাদামাটির অপরূপ পাহাড় বিজয়পুর। সাদা ছাড়াও গোলাপী, লাল, বেগুনী, ও ধূসর মূল্যবান মাটি এই সোমেশ্বরীরই অবদান।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন