মনা সর্দার - এক গণনায়ক ও আমরণ বিপ্লবী

মনা সর্দার একজন গণনায়ক ও আমরণ বিপ্লবী। উনিশ শতকে নেত্রকোণা তথা বৃহত্তর ময়মনসিংহের কৃষক বিদ্রোহ ও আদিবাসী বিদ্রোহের বিপ্লবী নেতা । তাঁর জন্ম দুর্গাপুর, সুসঙ্গ। তবে, তাঁর জন্মের তারিখ/ বছর সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। 

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এ অঞ্চলের কৃষকরা নানা নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পর বিদ্রোহ করেছিল। কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহ ছিল বাধ্যতামূলক হাতি খেদার বিরুদ্ধে সুসং পরগনার হাজং বিদ্রোহ। তৎকালীন ময়মনসিংহের সুসঙ্গ আলপ সিংহ পরগনার “হাতি খেদা' আন্দোলনে বীরোচিত নেতৃত্ব দেন মনা সর্দার। আন্দোলনের এক পর্যায়ে নির্মম অত্যাচারী জমিদারদের হাতে বন্দি হন তিনি।কলমাকান্দার জমিদারের কুখ্যাত লাঠিয়াল বাহিনী এ বিপ্রবীকে ১২২৭ বঙ্গান্দের ৪ পৌষ তারিখে (১৮২০ সাল ) হাতির পায়ের তলায় পিষ্ট করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। 

প্রসংগত উল্লেখ্য, পাহাড়ী অঞ্চলের গভীর অরণ্যের মধ্যে হাতির প্রিয় খাবার কলাগাছ ও ধান চাষ করে তার চারপাশে গজারি গাছের খুঁটি দিয়ে বেষ্টনী তৈরি করা হতো। বন্যহাতির দল কলাগাছ ও ধান খাবার লোভে পাহাড় থেকে দলবেঁধে নেমে আসত। অতঃপর গজারি বেষ্টনী বা খেদার মধ্যে প্রবেশ করলেই হাজংরা খেদায় ঢোকার পথগুলো বন্ধ করে দিত। এরপর গৃহপালিত হাতির সহায়তায় বন্যহাতিদের বশ করে তাদের পায়ে শিকল পরিয়ে বাইরে নিয়ে আসা হতো। যেসব হাতি পরবর্তীতে জমিদারগণ ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, দিল্লি প্রভৃতি অভিজাত জায়গায় বিক্রি করে প্রচুর অর্থ আয় করতেন। 

হাতি বিক্রয় করে জমিদারগণ বহু অর্থ-সম্পদ ার্জণ করলেও এ কাজের জন্য হাজংদের কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হতো না। বরং হাতি ধরার কাজে না আসলে জমিদাররা স্থানীয় আদীবাসিদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার চালাত। এছাড়া, প্রতি বৎসর বহু হাজং চাষিকে বন্যহাতির পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে জীবন দিতে হতো। এ নিয়ে বহুকাল ধরে হাজংদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে, যা পরবর্তীতে আন্দোলনে রুপ নেয়। হাজংরা বিদ্রোহের পথ বেছে নিলে সুসং জমিদারগণ নানাভাবে অত্যাচার ও উৎপীড়ন চালানো আরম্ভ করে। আর সে সময় হাজং নেতা মনা সর্দার দুর্গাপুরে হাতি খেদার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেন। গারো চাষিরাও সে সময় বিদ্রোহী হাজংদের সঙ্গে যোগ দেয়। সমগ্র সুসঙ্গ-পরগনায় জ¦লে উঠে বিদ্রোহের আগুন। একপর্যায়ে, বিদ্রোহের প্রধান নায়ক মনা সর্দারকে জমিদাররা কৌশলে আটক করে এবং পরবর্তীতে তাকে বুনো হাতির পায়ের তলায় পিষে নির্মমভাবে হত্যা করে।

মনা সর্দারের নৃশংস মৃত্যুতে বিদ্রোহ নতুন মাত্রা পায়। বিদ্রোহীরা একযোগে সুসং-এর বারোমারি ময়দানে আক্রমণ করে। সে সময় জমিদারদের হাতিগুলোর হাজং মাহুতগণও তাদের হাতিগুলোকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। এতে জমিদারদের বহু পাইক-বরকন্দাজ হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে মারা যায়। অতঃপর হাজং ও গারো কৃষকদের সম্মিলিত বাহিনী সুসং-দুর্গাপুর আক্রমণ করে এবং একপর্যায়ে জমিদার-পরিবার প্রাণ বাঁচাতে নেত্রকোনা শহরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বিদ্রোহীরা বিজয়পুর, ধেনকী, ভরতপুর, আড়াপাড়া, ফারাংপাড়া, চেংনী প্রভৃতি স্থানের সব হাতি খেদা পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলে।

Share on Google Plus

About Ripon Abu Hasnat

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন