মুক্তিযোদ্ধা, কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, লেখক, সংগঠক ও উপস্থাপক মোস্তফা জব্বার

মুক্তিযোদ্ধা, কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, লেখক, সংগঠক ও উপস্থাপক মোস্তফা জব্বার ১৯৪৯ সালের ১২ আগস্ট নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুরীর কৃষ্ণপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আব্দুল জব্বার তালুকদার এবং মায়ের নাম রাবেয়া খাতুন। নিজ গ্রামের প্রাইমারি স্কুল থেকে তিনি ১৯৬০ সালে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষা সম্পন্ন করেন। কিন্তু নিজ গ্রামে বা তার গ্রামের আশেপাশে কোন হাইস্কুল না থাকায় তিনি হাইস্কুলে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। কিন্তু বাবা-মা এবং নিজের কঠোর ইচ্ছাশক্তির কারণে গ্রামের বাড়ী থেকে ২৫ কিলোমিটারের দূরে হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার অধীনস্হ বিরাট নামক একটি গ্রামের হাইস্কুলে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন ও ১৯৬৬ সালে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে হবিগঞ্জ কেন্দ্র থেকে মানবিক শাখায় দ্বিতীয় বিভাগে মাধ্যমিক  পাশ করেন। এরপর মানবিক শাখায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। তারপর সে বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক ভর্তি হন। ১৯৭২ সালে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ পরীক্ষাটি ১৯৭১ সালে হবার কথা ছিলো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কারণে তা হয়নি। এরপর তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।

মোস্তাফা জব্বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাতে অংশগ্রহণ করেন। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ১৬১ জন রাজাকার যুদ্ধোত্তরকালে তার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ছাত্রজীবনে তিনি রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য চর্চা, সাংবাদিকতা, নাট্য আব্দোলন; এসবের সাথে ব্যাপকভাবে জড়িত ছিলেন। ৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তার লেখা বাংলাদেশের প্রথম গণনাট্য "এক নদী রক্ত" ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রে মঞ্চস্হ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি ছাত্রলীগের পক্ষে নির্বাচন করে সূর্যসেন হলের নাট্য ও প্রমোদ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন।
ছাত্র থাকাকালেই তিনি সাপ্তাহিক জনতা পত্রিকায় লেখালেখির সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭২ সালের ১৬ জানুয়ারি সাপ্তাহিক গণকণ্ঠ পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে। পরে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ পত্রিকাটি দৈনিকে পরিণত হয়। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গণকণ্ঠ পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হতো এবং সে সময় পর্যন্ত তিনি সেখানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নির্বাচিত হন।
গণকণ্ঠ বন্ধ হয়ে যাবার পর মোস্তফা জব্বার ট্রাভেল এজেন্সি, মুদ্রণালয়, সংবাদপত্র ইত্যাদি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি বাংলাদেশের ট্রাভেল এজেন্টদের সংগঠন আটাব (এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ)- এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৭ সালের ২৮শে এপ্রিল মেকিন্টোস কম্পিউটার স্পর্শ করার মধ্য দিয়ে তিনি কম্পিউটার ব্যবসা শুরু করেন। সেই বছরের ১৬ মে তিনি কম্পিউটারে কম্পোজ করা বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা আনন্দপত্র প্রকাশ শুরু  করেন। ১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর কম্পিউটারের বাংলা কী- বোর্ড বিজয় এবং বাংলা সফটওয়্যার বিজয় প্রকাশ করেন। সেটি প্রথমে মেকিন্টোস কম্পিউটারের জন্য প্রণয়ন করলেও পরে ১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ তা উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের জন্যও প্রকাশ করেন। তিনি আনন্দ প্রিন্টার্স এবং আনন্দ মুদ্রায়ণের প্রতিষ্ঠাতা। তার হাতেই গড়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল বাংলা নিউজসার্ভিস আনন্দপত্র বাংলা সংবাদ বা আবাস। তিনি এর চেয়ারম্যান ও সম্পাদক।তিনি ইতিপূর্বে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির নির্বাহি পরিষদের সদস্য, কোষাধ্যক্ষ ও সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এন্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস ( বেসিস ) এর প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি ও পরিচালক এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। ২০০৮-০৯ সময়কালে তিনি দ্বিতীয় বারের মতো বাংলাদেশ কম্পিউটরার সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০-১১ সালে তিনি তৃতীয় বারের মতো বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১২-১৩ সময়কালেও তিনি এই সমিতির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি একসময় নেত্রকোনা যুব সমিতির সভাপতির দ্বায়িত্বও পালন করেন।

তিনি কম্পিউটার বিষয়ক বহু বাংলা বইয়ের প্রণেতা এবং বিটিভি, এটিএন ও চ্যানেল আই সহ বিভিন্ন চ্যানেলে কম্পিউটার বিষয়ক বহু অনুষ্ঠানের উপস্থাপক। তার প্রথম উপন্যাস নক্ষত্রের অঙ্গার ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও কম্পিউটার কথকতা, ডিজিটাল বাংলা, একুশ শতকের বাংলা, বাঙ্গালী ও বাংলাদেশ, ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং একাত্তর ও আমার যুদ্ধ তার লেখা বইগুলোর অন্যতম।

তথপ্রযুক্তিতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সেরা সফটওয়্যারের পুরষ্কার, পশ্চিমবঙ্গের কমপাস কম্পিউটার মেলার সেরা কমদামী সফটওয়্যারের পুরষ্কার, দৈনিক উত্তরবাংলা পুরষ্কার, পিআইবির সোহেল সামাদ পুরষ্কার, সিটিআইটি আজীবন সম্মাননা ও আইটি এওয়ার্ড, বেসিস আজীবন সম্মাননা পুরষ্কার ও বেস্টওয়ে ভাষা-সংস্কৃতি পুরষ্কারসহ ১৬টি পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়াও তার রয়েছে অসংখ্য সম্মাননা।
Share on Google Plus

About Ripon Abu Hasnat

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন